দিনমজুরের কাজ করেন আবদুল ওয়াহেদ মিয়া। স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে সংসার। দিনমজুরি করে কোনোমতে চার সদস্যের সংসার চলে। বসতভিটায় দুটি কুঁড়েঘর। সেই ঘরের ভেতরে এখন কোমরপানি। ভেসে আছে চৌকি।
পানিতে ডুবে থেকে ঘরের বেড়া, আসবাব নষ্ট হয়েছে। মাঠঘাট পানিতে ডুবে থাকায় দিনমজুরের কাজও বন্ধ। ধারদেনা করে চলতে হচ্ছে গাইবান্ধার খারজানি গ্রামের এই পরিবারটিকে।
ওয়াহেদের স্ত্রী আজেদা বেগম (৫০) খাওয়ার পানি আনতে উঁচু জায়গায় যাওয়ার পথে বললেন, ‘এব্যারক্যা বানোত হামারঘরে ম্যালা খতি হচে। বানোত হামারঘরে সগ কিচু শ্যাস হয়া গেচে। সাত দিন থাকি পানিত আচি। ঘরোত খাবার নাই। চেরমেনের কাচে গেচিনো। ইলিপ পাই নাই।’
গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে কামারজানি বাজার। সেখান থেকে নৌকাযোগে প্রায় এক ঘণ্টার পথ খারজানি। এবারের বন্যায় গোটা গ্রামটা প্লাবিত হয়েছে। পার্শ্ববর্তী কুন্দেরপাড়া গ্রামেরও একই অবস্থা। ব্রহ্মপুত্র বেষ্টিত এই এলাকা নদীভাঙন চিরচেনা। উপরন্তু করোনাকালে এলাকাবাসীর অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। এর মধ্যে এসেছে বন্যা।
শুক্রবার সকালে সরেজমিনে বন্যাকবলিত গ্রামের মানুষের দুর্ভোগের চিত্র চোখে পড়ে। কোমরপানিতে ডুবে আছে ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট। বাড়ির উঠোনে ছোট ছেলেমেয়েরা নৌকায় খেলছে। অনেকে নৌকায় বসে ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করছেন। কেউ চৌকির ওপর রান্নাবান্না করছেন।
খারজানি গ্রামের বাসিন্দা হাজেরা বেগম (৬০)। দুই ছেলে ও স্বামীকে নিয়ে সংসার। স্বামী ইসলাম মিয়া কৃষক। এক সময় পাঁচ বিঘা জমি ও বসতভিটা ছিল। কয়েক বছরে নদীভাঙনে সবই শেষ। এখন অন্যের জমিতে ঘর তুলে থাকছেন। দিনমজুরের কাজ করে সংসার চলে।
একই গ্রামের কৃষক বেলাল মিয়া (৫৫) বললেন, ‘হামারঘরে বাড়ির কাচে নদী। এমনিতে নদীত পানি বাড়লে হামারঘরে ঘরবাড়ি ডুবি যায়। এরমদ্দে বান আসি হামরা হাবুডুবু খাবার নাগচি। উচা জাগাত যাই নাই। সাত দিন থাকি কসটো করি পানির মদ্দে আচি। বানের মদ্দে কোনো ইলিপ পানো না।’
একই গ্রামের কৃষক জামাল মিয়ার বাড়ির চারটি ঘর ও একটি নলকূপ ডুবে গেছে। ডুবে যাওয়া নলকূপের পানি পান করার উপযোগী নেই। তাই নদীর পানি ফুটিয়ে খাচ্ছেন। এই পানি খেয়ে অনেকের পেটের সমস্যা দেখা দিয়েছে। সরকারিভাবে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা হয়নি। বন্যার পানিতে বাড়ির শৌচাগার ভেসে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন নারী-পুরুষ সবাই।
স্থানীয় কামারজানি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুস ছালাম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ইউনিয়নের মধ্যে খারজানি গ্রাম বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। এবারের বন্যার পর ইউনিয়নের জন্য এ পর্যন্ত সাত মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পেয়েছেন। ১০ কেজি করে ৫৫০ জনের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ৩৫ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এখন তাঁর হাতে কোনো ত্রাণ নেই। তাই দিতে পারছেন না।
ইউনিয়নে লোকসংখ্যা প্রায় ২২ হাজার জানিয়ে চেয়ারম্যান বলেন, ১৫ হাজারের বেশি মানুষ অভাবী। সে অনুপাতে তিনি ত্রাণ বরাদ্দ পান না।
গাইবান্ধা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবদুর রাফিউল আলম বলেন, বন্যায় যেসব ইউনিয়ন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, সেগুলোতে বেশি ত্রাণ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।